কুড়িগ্রামে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনার বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তির শেষ পর্যায়ে এসেছে। সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন ছাড়া তৎকালীন রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা এবং নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) এস এম রাহাতুল ইসলামকে বিভিন্ন মেয়াদে দন্ড দেওয়া হয়েছে। সুলতানা পারভীনের বিভাগীয় মামলা বিচারিক প্রক্রিয়াও যেকোনো দিন নিষ্পত্তি হতে পারে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসন ও অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
অভিযোগের তীর সবচেয়ে কম ছিল সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমার দিকে। সেই রিন্টু বিকাশ চাকমাকে গুরুদন্ড দিয়ে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হচ্ছে। গত ২ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় রিন্টু বিকাশের বরখাস্তের সিদ্ধান্তে মতামতের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) পাঠায়।
পুরো বিচারিক প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, বিভাগীয় মামলার যিনি মূল অভিযুক্ত সেই নাজিম উদ্দিন অপেক্ষাকৃত কম গুরুদন্ড পেয়েছেন। তাকে সিনিয়র সহকারী কমিশনার থেকে একধাপ নিচে নামিয়ে সহকারী কমিশনার করা হয়েছে। দন্ড দেওয়া হলেও এখনো তাকে পোস্টিং দেওয়া হয়নি। তবে পোস্টিং দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
২০ জুন রিন্টু বিকাশকে বরখাস্তের সিদ্ধান্তে সম্মতি জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে পিএসসি। বরখাস্তের প্রক্রিয়ার ধাপ পূরণের জন্য এ সংক্রান্ত ফাইলটি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রয়েছে। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর করার পর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির চূড়ান্ত প্রস্তুতি রয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের।
গুরুদন্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে রিন্টু বিকাশ চাকমা বলেন, ‘আমি এখনো গুরুদন্ডের কথা জানি না। তবে আমার দৃঢ়বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত আমি নির্দোষ সেটা প্রমাণ হবে। বিচারাধীন বিষয়ে আর কিছু বলা ঠিক নয়। ’
অপর সহকারী কমিশনার বা কুড়িগ্রামের সাবেক এনডিসি এস এম রাহাতুল ইসলামের তিনটি ইনক্রিমেন্ট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পোস্টিংও দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি সেখানেই কর্মরত আছেন। সাজার বিষয়ে জানতে চাইলে রাহাতুল ইসলাম বলেন, ‘বিচারাধীন বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। ’
গত বছরের ১৪ মার্চ কুড়িগ্রামে মধ্যরাতে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামের বাড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালত ঢুকে তাকে ধরে নিয়ে জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট এক বছরের কারাদন্ড দেয়। তার বাড়িতে আধা বোতল মদ এবং গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এভাবে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ ঘটনা ফলাও করে প্রচার হলে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে। ডিসি সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন ও দুই সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এস এম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম গতকাল বুধবার বলেন, ‘এই ঘটনার মাস্টার মাইন্ড ছিলেন তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীন। আরডিসি নাজিম উদ্দিন সে অনুযায়ী অভিযান কার্যকর করেছেন। রিন্টু বিকাশ চাকমা সেদিন শুধু বিচারিক কাগজে স্বাক্ষর করেছেন মাত্র। সাজা নির্ধারণ করেছিলেন নাজিম উদ্দিন। আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও করেছেন নাজিম উদ্দিন। সে চাকরিতে বহাল থাকে কীভাবে? রিন্টু বিকাশ চাকমাকে বলির পাঁঠা বানিয়ে সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন এবং আমাকে নির্যাতনকারী আরডিসি নাজিম উদ্দিনকে নামকাওয়াস্তে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ওই দিন রিন্টু বিকাশ চাকমা অভিযানে অংশ নেওয়া ছাড়া আমার সঙ্গে দৃশ্যমান কোনো অপরাধ করেননি। মূলত রিন্টু বিকাশকে শাস্তি দিয়ে মূল অভিযুক্ত সুলতানা পারভীন ও নাজিম উদ্দিনকে বাঁচিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের হলেও তারা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় বিভিন্নভাবে মামলা প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। ফলে ঘটনার প্রায় দেড় বছর হলেও পুলিশ এখনো পর্যন্ত কোনো চার্জশিট দেয়নি। ’
নাজিম উদ্দিনকে গুরুদন্ড না দিয়ে নিম্নধাপে নামিয়ে দেওয়ার মতো কম গুরুদন্ড কেন দেওয়া হলো জানতে চাইলে জনপ্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, নিম্নধাপে নামিয়ে দেওয়াও কম শাস্তি নয়। সারা জীবন জুনিয়রদের সঙ্গে কাজ করা সহজ নয়। সারা জীবন নাজিম উদ্দিনকে এ শাস্তি ভোগ করতে হবে। তারপরও এ শাস্তি হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে কাগজেপত্রে নাজিম উদ্দিন সবসময় সেইফ সাইডে ছিলেন। আর রিন্টু বিকাশ চাকমা তা করতে পারেননি। এছাড়া তার কারণ দর্শানো নোটিসের জবাবও হয়তো প্রত্যাশামাফিক হয়নি। সবকিছু মিলেই চাঞ্চল্যকর বিষয়টি এভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
গত বছরের ২৫ জুন কারণ দর্শানো নোটিসের জবাব দিয়েছেন সুলতানা পারভীন। এর আগে আরডিসি নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার ও মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এনডিসি এস এম রাহাতুল ইসলাম বিভাগীয় মামলায় আনা অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। কারণ দর্শানো নোটিসের জবাবে সুলতানা পারভীন জানিয়েছেন, তিনি মধ্যরাতে সাংবাদিক আটক ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় ঘুমিয়ে ছিলেন। মোবাইল ফোনে আসা ‘মিসড কল’ নম্বরে পর দিন সকালে ফোন ব্যাক করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিবের নিকট থেকে প্রথম ঘটনা শুনেছেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বিভাগীয় মামলায় সুলতানা পারভীনের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এর জবাবে তিনি বলেছেন, পত্রিকাগুলো কিসের ভিত্তিতে এ অভিযোগ করেছে তা তার বোধগম্য না। সুলতানা পারভীন জানিয়েছেন তিনি কোনো মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেননি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য তিনি কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা দেননি। এ বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন না।
এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে মধ্যরাতে সাংবাদিক আটকের সময় সেখানে উপস্থিত না থাকার দাবি করেছেন আরডিসি নাজিম উদ্দিন। তিনি কেবল কাস্টডি ওয়ারেন্টের সাজাপ্রাপ্ত আসামি সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে জেলাখানায় গ্রহণের পদ্ধতিগত আনুষ্ঠানিকতা করার দাবি করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কারণ দর্শানো নোটিসের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। গত বছরের ৩ জুন তিনি কারণ দর্শানোর নোটিসের জবাব দেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকার দাবি করলেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার কারণ দর্শানো নোটিসের জবাবে নাজিম উদ্দিনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতির কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছে।
Leave a Reply