এম আর মাইনউদ্দীন :-
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র জগতের আলোড়ন সৃষ্টিকারী চিত্র নায়ক সালমান শাহ’র ২৫ তম মৃত্যু বার্ষিকী ৬ সেপ্টেম্বর। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইস্কাটন প্লাজায় নিজের বাসায় রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। সালমান শাহকে সমাধিত করা হয় সিলেটের হযরত শাহলালাল (রঃ) মাজার সংলগ্ন গোরস্থানে। মৃত্যুর ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সালমান শাহ’র জনপ্রিয়তা একটুও ভাটা পড়েনি। তিনি খুন হয়েছেন নাকি আত্মাহত্যা করেছেন এ নিয়ে ২৫ বছর ধরে চলছে মামলার তদন্ত।কিছু দিন আগে পিবিআইয়ের সবশেষ প্রতিবেদনে দাবি করা হয় সালমান শাহ আত্মাহত্যা করেছেন। সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরী এই তদন্ত প্রতিবেদন মানতে নারাজ। তিনি প্রথম থেকেই বলে আসছেন আমার ছেলে ইমন (সালমান শাহর ডাক নাম) কে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সন্মেলন করে সাল মান শাহর মা নীলা চৌধুরী পিআইবি’র তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সালমানকে যে পরিকল্পিতভাবে হত্যার নানা যুক্তি ও ঘটনার পরম্পরা তুলে ধরেন।
চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন চলচ্চিত্রখ্যাত সালমান শাহর জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। তুলা রাশির জাতক। সেই হিসাবে মৃত্যুকালে সালমান শাহ’র বয়স হয়েছিলো ২৫ বছর। রোমান্টিক নায়ক সালমান শাহর শিল্প চর্চা শুরু শিশু বয়স থেকেই বিটিভির মাধ্যমে। সালমান শাহ ছোটদের অনুষ্ঠান নতুন কুড়ি’তে প্রথম অংশ নেন ১৯৭৬/৭৭ সালে। ছোটবেলায় বিটিভিতে সব সময় দেখা যেতো সালমান শাহকে। পাশাপাশি গান গাইতেন। ১৯৮৫ সালে ইস্পাহানি গোল্ড স্টার টি এর বিজ্ঞাপনের মডেল হন। এর পরের বছর সালমান শাহ প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করেন শিশু চরিত্রে। এরপর টিভি নাটক ও মডেলিং চালিয়ে যান বেশ কয়েক বছর।
সালমান শাহ ১৯৯৩ সালে চলচ্চিত্র জগতে এসেছিলেন। সোহানুর রহমান সোহানের পরিচালনায় কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবিতে মৌসুমীর বিপরীতে অভিনয় করে সবার নজরে আসেন। এ ছবিটি সুপার ডুপার হিট হয়।তার পর থেকেই সালমান শাহকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সুপার হিট ছবি হয় সালমান শাহর। সালমান শাহ ২৭ টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত ছবিগুলো হচ্ছে কেয়ামত থেকে কেয়ামত, তুমি আমার, অন্তরে অন্তরে, রঙিন সুজন সখি, বিক্ষোভ, স্নেহ, প্রেম যুদ্ধ, কন্যা দান, দেন মোহর, সপ্নের ঠিকানা, আঞ্জুমান, মহা মিলন, আশা ভালোবাসা, বিচার হবে, এই ঘর এই সংসার, প্রিয়জন, তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, সত্যের মৃত্যু নেই, জীবন সংসার, মায়ের অধিকার, চাওয়া পাওয়া, প্রেম প্রেয়াসী, স্বপ্নের নায়ক, শুধু তুমি, আনন্দ অশ্রু ও বুকের ভেতর আগুন।
সালমান শাহ’র শৈশব-কৈশোর কেটেছে সিলেট শহরে। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে দল বেধে ঘুরে বেঙানো আর খেলাধুলাই ছিলো তার একমাত্রই কাজ। সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসা মাঠে খেলাধুলা করতেন সালমান শাহ। ভালো ক্রিকেট খেলতেন। সালমান শাহ’র বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার ছাহগলীতে হলেও সালমান শাহ তার নানা বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের অন্যতম অভিনেতা কামরুজ্জামান চৌধুরীর সিলেট শহরের দাঁড়িয়া পাড়ার বাড়িতে (সালমান শাহ ভবন) জন্ম ও বেড়ে হয়ে উঠেছেন।
সালমান শাহ’র বাবা মরহুম কমর উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন এর ম্যাজিস্টেট। মা নিলা চৌধুরী ছিলেন একজন রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব। সালমান শাহর একমাত্র ছোট ভাই চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরান ইভান (বিলটু)। সালমান শাহর মা ও ছোট ভাই এখন স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন।
অভিনয়ের পাশাপাশি সালমান শাহ ছিলেন একজন যোগ্য মডেল। ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়েই শুধু চলতেন না, সালমান শাহ বরং নিত্য নতুন ফ্যাশনের উদ্ভাবক ছিলেন তিনি। সালমান শাহ’র মাথার সেই টুপি এখনো ফ্যাশন হয়ে আছে। স্কার্ফও মাথায় পঙতেন সালমান শাহ। সেই স্কার্ফও ফ্যাশন হয়ে আছে। আগে চলচ্চিত্রে নায়ক বলতে ছিলো চুল হবে বড়, লম্বা। সালমান শাহ সে ধারা পরিবর্তন করেন। ছোট চুল নিয়ে অভিনয় করে সালমান শাহ চলচ্চিত্র তথা গোটা বাংলাদেশে নতুন ফ্যাশনের জোয়ার নিয়ে আসেন। একজন তরুণ শিল্পীর জন্য এটাও কি কম পাওয়া? সালমান শাহ মৃত্যুর আগে অবশ্যই চুল লম্বা রেখেছিলেন। চুল লম্বা রেখে পিছনে গুচ্ছি বেঁধে অভিনয় করতেন। এটাও ফ্যাশন ছিলো।
সালমান শাহ ছিলেন কৌতুক প্রিয়। হাসি তামাশা করতে ভালো বাসতেন। সালমান শাহর কথায় বিনয় ও ভদ্রতার পরিচয় ফুটে ওঠতো। তার বিনয়ী ব্যবহার ও চৌকস আচরনের জন্য সিনেমা পাঙায় ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। যেনোতেন ছবিতে অভিনয় করতেন না। গল্প দেখতেন। ভালো লাগলে করতেন। কত অফার আসতো তার ইয়ত্বা নেই।
সালমান শাহ তার অভিনীত ছবি সুন্দর হওয়ার জন্য নিজেই ঝুঁকিপূর্ণ শট নিতেন। বেশীর ভাগ ছবিতে সালমান শাহ ডামি ব্যবহার করতে দিতেন না। বাংলাদেশের মধ্যে একজন নায়কই ছিলেন যিনি ডামি ব্যবহার ছাঙা ঝুঁকিপূর্ণ শট নিতেন, তিনি হলেন সালমান শাহ। এব্যাপারে তিনি প্রায় বলতেন – দর্শক টাকা দিয়ে টিকেট কেটে হলে যায়। তাদের আমি ঠকাতে পারবো না। কারো ঠকানো উচিত নয়। এসব ভেবে ঝুঁকিপূর্ণ শট নিতেন সালমান শাহ।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে ৬ সেপ্টেম্বর তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র হারিয়েছে সবচেয়ে প্রতিভাবান এক তারকাকে, যিনি খুবই কম সময়ের মধ্যে বদলে দিয়েছিলেন গোটা চলচ্চিত্র জগৎ। তাঁর অকাল প্রস্থানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যে শূন্যতার সৃষ্টি চেয়েছিলো, গত ২৫ বছরেও সেই শূন্যতা পূরণ হয়নি। আজকের এই দিনে আমরা তাকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধার সাথে।
Leave a Reply